সজিনার গুণের কথা
.
সজিনার কথা মনে হতেই প্রথমে মনে আসে কবির কবিতায় সজিনা ফুলের কথা। এমনই এক শ্রেষ্ঠ কবিতা জীবনানন্দের "এখানে আকাশ নীল"--
কবি সজিনা ফুলের রূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন...
"এখানে আকাশ নীল
নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা
রং তার আশ্বিনের আলোর মতন"
সজিনা গাছ মানুষের বসতবাড়ীর আশে পাশে অনেক দেখা যেত অতীতে, অর্থাৎ ২০/২৫ বছর আগেও। বাড়ীর আঙিনার একপাশে বা পিছনের বাগানে এদের ঠাই মিলতো, এমন কি বাড়ীর সামনের বাগানে ও কখনো কখনো এদের দেখা মিলতো। একটা ডাল পুতে দিলেই শিকড় গজিয়ে যেত, তেমন কোনো যত্নআত্তি ছাড়াই এরা বেশ খুশি মনে লকলক করে বেড়ে উঠতো। একদিন সেই ডাল থেকে গজানো ছোট বৃক্ষ শিশু যেন পরিপূর্ণ বৃক্ষে রুপান্তরিত হতো। বাড়ির আশপাশে অনাদরে বেড়ে ওঠা সজিনা গাছ এখন আর অবহেলার নয়। সবজি হিসেবে এটি যেমন উপাদেয়, তেমনি এর ভেষজ গুণাবলী অসাধারণ।
বহুগুণে সমৃদ্ধ হওয়ার কারনে সজিনাকে আমাদের দেশে বিভিন্ন নামে উল্লেখ করা হয়। সাজনা, শোভাঞ্জন, উপদংশ, সুপত্রক, রুচিরঞ্জক, সুখামোদ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর বৈজ্ঞানিক নাম (Moringa Oleifera) এরা (Moringaceae) পরিবারের সদস্য। ইংরেজিতে সজিনাকে Horse radish tree, Drumstick tree বা ben oil tree বলা হয়। সজিনা বা সাজনা এর বাংলা নাম। এটা আমাদের দেশে একটি বহুল পরিচিত গাছ। প্রায় একডজন প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে দুটি প্রজাতি দেখা যায় যার একটি Moringa oleifera এবং অন্যটি Moringa concanensis। দ্বিতীয় প্রকার গাছের পাতার আগা চোখা এবং কম ঘন। এগুলো খুলনা কুষ্টিয়া যশোর ইত্যাদি এলাকায় দেখা যায়। এর কাঁচা লম্বা ফল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী উদ্ভিদ।
খ্রিষ্টের জন্মের ১৫০বছর আগের ভারতীয় প্রাচীণ ভেষজ লেখনীতে সজিনার ঔষধি গুণের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই পুরাকাল থেকেই ভেষজ পন্ডিতগন এর বিভিন্ন রকম গুণের কথা উল্লেখ করে আসছেন। সজিনার মূল, ছাল, ফুল, ফল, বীজ, পাতা সবকিছুতেই মহাঔষধি গুণ বিদ্যমান। এর প্রধান ঔষধি রাসায়নিক পদার্থ হচ্ছে,বিটা- সিটোস্টেরোল,এক্যালয়েডস-মোরিনাজিন। আর ফুলে আছে জীবানুনাশক টিরিগোজপারমিন। এর মধ্যে আছে ভিটামিন এ,বি,সি,প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় পদার্থ, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি।
পুষ্টি এবং বিভিন্ন খাদ্যগুণে গুণান্বিত সজিনা। বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন খাদ্য প্রজাতির মধ্যে সর্বোচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন উদ্ভিদ হিসেবে এই গাছকে উল্লেখ করা হয়। সজিনা গাছকে “পুষ্টির ডিনামাইট” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অতীত এবং বর্তমান বিভিন্ন সময়ের বিজ্ঞানীরা। দক্ষিণ আফ্রিকায় এই গাছকে ‘জাদুর গাছ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে নানাবিধ গুণে সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য। বর্তমানে সজিনা গাছের বিভিন্ন অংশ যেমন ফুল, পাতা, গাছের ছাল, বাকল, শিকড় ইত্যাদি প্রায় ২০০ প্রকার রোগের প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশে সজিনা নিয়ে তেমন গবেষণা না হলেও বিশ্বের বহু দেশে এ নিয়ে অনেক গবেষনা হয়েছে এবং এখনো অনেক গবেষণা হচ্ছে। বিশেষ করে গাছ বৃদ্ধিকারক হরমোন, ঔষধ, কাগজ তৈরী ইত্যাদি বিষয়ে। যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশে সজিনা সবজির পাশাপাশি ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে দুই ধরনের সজিনার কথা উল্লেখ রয়েছে যেমন, লাল ও সবুজ। লাল রঙের সজিনা এখন আর তেমন দেখা যায়না। সবুজ রঙের সজিনাই বেশী পাওয়া যায়।
সজিনা গাছ দুই ভাবেই জন্মায় বীজ ও গাছের ডাল থেকে। মূলত, ডাল থেকেই বেশী জন্মায়। বর্ষাকালে ডাল রোপন করতে হয়। সাধারণত এই গাছের উচ্চতা ২০ ফুট থেকে ৩০ ফুট অথবা তারও বেশি হয়ে থাকে। এই গাছের কাঠ অত্যন্ত নরম, বাকল আঠাযুক্ত। এটা একটি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ এবং একটি মৌসুমি ফল। আমাদের দেশে এখনো বাণিজ্যিক ভাবে তেমন সজিনার চাষ করা হয়না। শুধু চৈত্র,বৈশাখ মাসে কিছুদিনের জন্য সজিনা পাওয়া যায়। এর পাতা অগ্রহায়ণ মাসে হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে। মাঘ-ফাল্গুনে থোকা থোকা সাদা ফুল পত্রশূন্য গাছ প্রায় ছেয়ে থাকে।
আমাদের দেশে সজিনা সবজি ছাড়াও ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এর কচি পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়ে থাকে। পাতা পুষ্টি ঘাটতি পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সজিনার পাতার গুঁড়োরও বিশেষ গুণাগুণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এতে দুধের চেয়েও বেশি ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম ও জিংক রয়েছে। এর ফুল ভাজি করে অথবা শাকের মত রান্না করে খাওয়া হয়। এই ফুল বসন্ত রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। সজিনার বীজের তেল আমাদের দেশে তেমন পাওয়া যায় না। একে ‘বেন অয়েল’ বলে। এটি ঘড়ি মেরামতের কাজে লাগে।
অশেষ গুণাবলী সমৃদ্ধ এই সজিনা এবং সজিনার পাতা খেলে খাবারে রুচি বাড়ে,শ্বাসকষ্ট কমে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হয়। এর পাতা বেটে অল্প গরম করে ফোঁড়ার ওপর লাগালে ফোঁড়া ফেটে যায় এবং টিউমার বা আঘাত জনিত ফোলা স্থানে লাগালে সেটাও কমে যায়। সজিনা পাতার রস মাথায় ঘষলে খুসকি দূর হয়। এর পাতার রসে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার ক্ষমতাও রয়েছে। সজিনার মূল ও বীজ সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। আরো বহু বহু রকম রোগে সজিনা, এর পাতা, মূল, ফুল ইত্যাদির ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর ভেষজ গুণ তুলনাহীন।
ছবিসূত্রঃ
১। সজিনা গাছ-সূত্র-নেট
২। সজিনা ফুল-সূত্র-নেট
৩।গাছে সজিনা-সুত্র-নেট
৪। সজিনার গুড়া-সুত্র-নেট
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন