PARAPHILIA-লাম্পট্যের রোগ
খাদ্য ও যৌনতা প্রত্যেক জীবের মৌলিক চাহিদা।খাদ্য ছাড়া যেমন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না ঠিক তেমনি যৌনতাও জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।আজকাল খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানোর ফলে তা যেমন সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ঠিক তেমনি অসুস্থ যৌনাচারও আমাদের মানসিক সুস্থতার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।যারা এহেন অপকর্মে লিপ্ত তাদের আমরা লম্পট,চরিত্রহীন কিংবা দুঃশ্চরিত্র হিসাবে চিহ্নিত করি।অথচ এসব চরিত্রহীনদের একটা বিরাট অংশ এসব করে থাকে প্যারাফিলিয়া নামক
মানসিক রোগের কারণে।এসব রোগের ব্যাপারে আমাদের অসচেতনতা ও উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে এরূপ নরাধমের সংখ্যা ও তাদের অনৈতিক কর্মকান্ড অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলছে;সমাজকে ঠেলে দিয়েছে পঙ্কিলতার অন্ধকারে।আজ শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নয়।“বাঁচতে হলে জানতে হবে” এ তাগিদ থেকেই আজকের এ পোষ্টটি লেখা।
প্যারাফিলিয়া কী?-গ্রীক শব্দ ‘Para’ মানে ‘beside’ এবং ‘Philia’ মানে ‘love/attraction’ অর্থাৎ Paraphilia কে বাংলায় অস্বাভাবিক যৌনাচার বা বিকৃত যৌনাচার বলতে পারি।যৌনমিলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রারম্ভিক ধাপ হলো যৌন উদ্দীপনা বা কামনা জাগ্রত হওয়া (sexual arousal)।প্যারাফিলিকরা এমন কিছু সঙ্গী(subject), জিনিস(object) বা অবস্থান (situation) থেকে যৌন উদ্দীপনা পেয়ে থাকে যা স্বাভাবিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। প্যারাফিলিয়া অনেকটা Obsessive Compulsive Disorder(OCD)এর মত অর্থাৎ এদের মাথায় প্রায় সময় অস্বাভাবিক যৌন চিন্তা/কল্পনা ঘুরপাক খেতে থাকে(obsession) এবং এর থেকে সৃষ্ট যৌন উদ্দীপনার দৃশ্যমানরূপ নানারকম অনৈতিক কর্মকান্ডে প্রকাশ পায়(compulsion)।সংক্ষেপে এর বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ
০১)স্বাভাবিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বা সাধারণ বিবেচনায় যেসব বিষয়-বস্তু যৌন উদ্দীপনা তৈরী করার কথা নয় তা থেকে যৌন উদ্দীপনা অনুভব করা।
০২)এসব বিষয়ের চিন্তা/কল্পনা(sexual fantasy) বেশীরভাগ সময় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া।অনেক সময় রোগী বুঝতে পারে যে তার এরূপ চিন্তা/কল্পনা করা ঠিক নয় তারপরেও সে তার এরূপ ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বরং ভাবনাই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।প্যারাফিলিয়ার মূল সমস্যটা এখানেই।
০৩)তার এই যৌন কল্পনাই তাকে যৌনকাতর করে তোলে এমনকি পরিপূর্ণ তৃপ্তিও দিতে পারে।
০৪)তার এই যৌন কল্পনার খোরাক যোগাতে কিংবা সৃষ্ট যৌন উদ্দীপনার কারণে সে নানারকম অনৈতিক বা অস্বাভাবিক যৌন আচরণ করে থাকে যা দেখে আমরা তাকে লম্পট বা বিকৃত যৌনাচারী হিসাবে চিহ্নিত করি।
০৫)রোগ হিসাবে চিহ্নিত করতে হলে কমপক্ষে ৬মাস কারো মধ্যে এরকম বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে।
০৬)প্যারাফিলিয়ার কারণে ব্যক্তিজীবন,পারিবারিক কিংবা সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
০৭)অনেক ক্ষেত্রে এরা বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গীর সাথে স্বাভাবিক শারীরিক মিলনও করতে পারে কিন্তু তাতে সে ততটা তৃপ্তি পায় না যা তাকে প্যারাফিলিয়া দিয়ে থাকে।ক্ষেত্র বিশেষে তারা তাদের স্বাভাবিক ও সুস্থ যৌনসঙ্গীকেও তার বিকৃত আচরণে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করে।তা করতে গিয়ে বেশীরভাগ সময় তার সুস্থ সঙ্গীটি মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হয়;এমনকি প্রাণ হারানোর শংকাও থাকে।
প্যারাফিলিয়ার কারণ কী?-মনস্তাত্বিক দৃষ্টিতে এসব বিকৃত যৌনাচারের প্রধান প্রধান কারণগুলো হলো-
১।অস্বাভাবিক ও বিকৃত পারিবারিক পরিবেশ।
২।শৈশবের তীব্র ও অনাকাঙ্খিত যৌন অভিজ্ঞতা।
৩।স্বাভাবিক ও বিকৃত যৌন আচরণের পার্থক্যকরণে অসমর্থতা।
৪।স্বাভবিক যৌনতার দীর্ঘমেয়াদী বঞ্চনা।
৫।বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভীতিকর অভিজ্ঞতা ও জটিল অনুভূতি।
৬।স্বাভাবিক যৌনসাথী ও যৌন শিক্ষার অভাব।
৭।শৈশবকালীন যৌন আচরণের পরিণত বয়সে পুণরাবৃত্তি।
এছাড়াও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা প্যারাফিলিয়ার সম্ভাব্য কারণ হিসাবে জেনেটিক ত্রুটি,গর্ভাবস্থায় শিশুর উপর সেক্স হরমোনের কুপ্রভাব,ব্রেনের বৃদ্ধির অসমতা,ব্রেনের গাঠনিক ও কার্যকারীতার ত্রুটিকে দায়ী করেছেন।
প্রকারভেদঃপ্যারাফিলিয়ার ধরণের শেষ নেই।প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভ্যারাইটি যোগ হচ্ছে এ তালিকায়।এখন পর্যন্ত সাধারণ ও বিরল সবমিলিয়ে শতাধিক রকমের প্যারাফিলিয়া সনাক্ত হয়েছে।এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্যারাফিলিয়া আপনাদের অবগতির জন্য তুলে ধরা হলো-
পেডোফিলিয়াঃ-Pedophilia(ল্যাটিন Pedo শব্দের অর্থ শিশু)।এক্ষেত্রে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ কাম-লালসা চরিতার্থ করার জন্য নাবালক শিশুকে যৌনসঙ্গী হিসাবে ব্যবহার করে।এ ধরণের বিকৃত যৌনাচারে শিশুর মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয় ঘটে এবং তা তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।ঘরের মধ্যে নিকট আত্মীয়,কাজের লোক, ড্রাইভার ও প্রতিবেশী দ্বারা এবং স্কুলে বা মাদ্রাসায় শিক্ষকের দ্বারা আমাদের শিশুরা অহরহ এ ধরণের অনাচারের শিকার হচ্ছে।
পিকটোফিলিয়াঃPictophilia (Picture=ছবি)।এ রোগের রোগীরা পর্ণোছবি,নারী-পুরুষের নগ্ন বা অর্ধনগ্ন ছবি বা ইরোটিক আর্ট দেখে তীব্র যৌন উদ্দীপনা ও তাড়না অনুভব করে থাকে।স্বাভাবিক সঙ্গমের তুলনায় পর্ণোতাতেই তারা বেশী সুখ ও আকর্ষণ অনুভব করে।ইন্টারনেটের কল্যাণে এদের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে।আমাদের দেশে এদের সংখ্যা কত তা জানা না গেলেও বিভিন্ন পর্ণো সাইটে সংযুক্ত ফ্ল্যাগ ও ভিজিটর কাউন্টার থেকে যা ধারণা পাওয়া যায় তা থেকে আমরা যদি বিশ্ব সেরা হই তাহলে অবাক হবো না।
র্যাপটোফিলিয়াঃRaptophilia (from Latin rapere, "to seize") বা Biastophilia(from Greek biastes, "rape") এর ক্ষেত্রে জোরপূর্বক ধর্ষণের সময় একজন নারী প্রতিরোধমূলক যেসব কাজ করে(কিল ঘুষি মারা,চিৎকার করা,কান্নাকাটি করা ইত্যাদি) সেগুলো তার জন্য যৌন উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে।মেয়েটির শরীর ভোগ করা তার মূল উদ্দেশ্য থাকে না।অবশ্য কামোত্তেজিত হওয়ার পর ধর্ষণ কিংবা ধরা পড়ার ভয়ে তাকে হত্যা করা হতে পারে।বৈধ স্ত্রী থাকার পরও তাদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখা যায় না।যারা একের পর এক ধর্ষণ করে সেঞ্চুরি হাকাচ্ছেন তারা এ রোগের রোগী হতে পারেন।
ন্যারেটোফিলিয়াঃ Narratophilia(Narrate=বর্ণনা করা)।এ ধরণের পুরুষরা মেয়ে দেখলেই তাদের সাথে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ চটুল কথাবার্তা শুরু করে দেয় এবং তার প্রভাব অবলোকন করে।এর দ্বারা সে যৌন উদ্দীপনা লাভ করে।মেয়েটির নির্লিপ্ততায় কিংবা না বলার অক্ষমতায় অথবা আস্কারায় এ উদ্দীপনা থেকে তীব্র যৌন তাড়না সৃষ্টির মাধ্যমে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের মত ঘটনাও ঘটতে পারে।দুলাভাই,স্বামীর বন্ধু,দেবর,অফিসের কলিগ এবং ইভ টিজারদের মধ্যে এরকম ন্যারেটোফিলিক দেখা যায়।
স্পর্শসুখ বা শ্লীলতাহানিঃএটাকে Toucherismও বলা হয়।অনেক মনোবিজ্ঞানী টাচেওরিজম ও ফ্রটেওরিজরমকে একই অর্থে ব্যবহার করেন।এ ধরণের কুকর্মের হোতা মূলতঃ পুরুষরাই।হাত দিয়ে অপরিচিত নারীর শরীর স্পর্শ করা,স্তনে চাপ দেওয়া,নিতম্বে চাপড় দেওয়া,চুমু খেতে চেষ্টা করা,যৌনাঙ্গে হাত বোলানো ইত্যাদি।বৈশাখী মেলা,বইমেলা,বাণিজ্যমেলা, ঈদের কেনাকাটার ভীড়ে,ঘরে নারীর একাকিত্বের সুযোগে কিংবা টিএসসির থার্টি ফার্ষ্ট নাইটেও এদের হ্রিংস থাবা প্রসারিত। নারীদেহের স্পর্শসুখই তাদের তীব্র কামোত্তেজনা তৈরীর জন্য যথেষ্ঠ।এ ঘটনাকে বার বার সে মনে করে পূণঃ পূণঃ যৌন উদ্দীপনা অনুভব করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হস্তমৈথুনের দ্বারা কামনার পরিসমাপ্তি ঘটে।
ফ্রটেওরিজমঃ-ভীড়ের মধ্যে প্রধাণতঃ নারীদের পশ্চাদদেশে লিঙ্গ ঘষে যৌনানন্দ লাভ করাই হলো ফ্রটেওরিজম।এ সমস্যা সবচেয়ে বেশী দেখা যায় বাসে বা ট্রেনে ভীড়ের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায়।সুতরাং ভিড়ের মধ্যে পেছন থেকে আপনাকে কেউ ঘষা দিলেই তাকে পকেটমার হিসাবে পাকড়াও করার আগে এ ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারেন।
পিপিংটমঃ-Peeping Tom বা Voyeurism।এ ধরণের বিকৃত যৌনাচারীরা বিপরীত লিঙ্গের গোপনাঙ্গ বা তাদের বিবস্ত্র হওয়া বা অন্যের যৌনসঙ্গম দেখার জন্য জানালা দিয়ে উঁকি মারে বা দরজার ফুটায় চোখ রাখে অর্থাৎ আড়াল থেকে এ ধরণের কর্ম দর্শনের মাধ্যমে যৌন উদ্দীপিত হয় এবং দর্শনরত অবস্থায় হস্তমৈথুন করে কামলীলা সাঙ্গ করে।দিন-রাত তারা শুধু এ চিন্তায় ব্যস্ত থাকে কোথায় ও কখন এ সুযোগ পাওয়া যাবে।
ফেটিসিজমঃ-Fetishism(fetish=নির্জীব বস্তুর প্রতি অন্ধ ভক্তি)।এ ধরণের বিকৃত যৌনাচারীরা যৌন উত্তেজনা থেকে অর্গাজম বা চরম পূলক পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে শুধুমাত্র বিপরীত লিঙ্গের একান্ত ব্যক্তিগত পোষাক বা তার ছবি বা তার ভালোবাসার কোন জিনিস দেখে বা এসব দ্বারা(যেমন-ব্রা,পেটিকোট,ব্লাউজ,ছবি) লিঙ্গতে পরশ বুলিয়ে।
পারশিয়ালিজমঃ-Partialism (part বলতে শরীরের একটি অংশকে বোঝানো হয়েছে)এটা ফেটিসিজমের মতই তবে এক্ষেত্রে নির্জীব জিনিসের পরিবর্তে শরীরের বিভিন্ন অংশ(যা সাধারণতঃ যৌন উদ্দীপক নয়) যৌন উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে।শরীরের এরকম অংশকে আদর করে বা লেহন করে বা এরূপ আচরণের কল্পনা করে তীব্র কামোত্তেজনা তৈরী হয় যা তাকে চরমপূলক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে।স্থানভিত্তিক এটাকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়।যেমন-
পডোফিলিয়াঃPodophilia(pod=পা)।পা দেখে বা তাতে আদর করে বা পায়ে আদরের কল্পনা করেই একজন চরম উত্তেজিত হয়ে যেতে পারে।এ রোগে ছেলে মেয়ে উভয়েই ভূগে থাকে।এ রোগের মেয়েদের পা কোন কারণে কোন পুরুষ স্পর্শ করা মাত্রই তারা প্রচন্ড কামাতুর হয়ে উঠে এবং দেহমিলনের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।অন্যন্য দেশের মত আমাদের দেশেও এটা বেশ দেখা যায়।
বেলী বাটন পারশিয়ালিজমঃNavel /belly button Partialism এ মেয়েদের নাভীই যৌন উত্তেজনার প্রধান অবলম্বন অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।
অ্যাক্সিলিজমঃ axillism বা armpit partialism এ বগলই যৌন উত্তেজনার প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়।
ট্রিকোফিলিয়াঃ trichophilia এর ক্ষেত্রে বিপরীত লিঙ্গের চুলে হাত বুলালে তীব্র কামনা তৈরী হয়।
ইনসেস্টঃ-INCEST।যাদের মধ্যে বিয়ে করা হারাম(যেমন পিতা-কন্যা,মা-ছেলে কিংবা আপন ভাই-বোন) তাদের মধ্যের যৌন সম্পর্ককেই ইনসেস্ট বলে।এধরণের প্যারাফিলিকরা রক্তের সম্পর্কের মানুষের সাথে যৌন সম্পর্কের কল্পনা থেকে প্রচন্ড যৌন উদ্দীপনা ও তাড়না লাভ করে যা তার স্বাভাবিক সঙ্গী দিতে পারে না।বর্তমানে এটি বিরল নয়।কয়েক বছর আগে পত্রিকায় দেখেছি এদেশের একজন নরাধম বাবা তার ১৫বছরের মেয়েকে দিনের পর দির এভাবে ভোগ করেছে ঘরে আটকে রেখে(তার স্ত্রী তার সাথে থাকত না)।ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে এলাকার লোকজন গণধোলাই দিয়ে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে।
স্যাডিজমঃ-এ ধরণের বিকৃত যৌনাচার ফরাসি দার্শনিক মারকুইস ডি স্যাডির নামকরণে করা হয়েছে যিনি যৌন অপরাধ ও এ সম্বন্ধীয় লেখার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।তিনি তার সঙ্গিনীকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করে যৌন উত্তেজনা অনুভব করতেন ।সঙ্গীর দেহের ব্যথা এ ধরণের ব্যক্তির জন্য যৌন উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে।কোন কোন ক্ষেত্রে বিকৃত ব্যক্তি যৌনসঙ্গীর শরীরে ধারালো অস্ত্র দ্বারা বা কামড়িয়ে আহত করার পর ক্ষত থেকে রক্ত চুষে খায়;এমনকি মাংস কামড়িয়ে যৌনানন্দ লাভ করে।আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনীটি যদি দেহমিলনের সময় অতিরিক্ত কামড়া কামড়িতে ব্যস্ত থাকে এবং বারণ করার পরও যদি তা থেকে বিরত না হয় তাহলে আপনি এ রোগটির কথা ভাবতে পারেন।
ম্যসোকিজমঃ-এ নামের উৎপত্তি হয়েছে অস্ট্রিয়ান ঔপন্যাসিক ম্যাসকের নামানুসারে।যিনি যৌন উত্তেজনা অনুভব করতেন বউয়ের হাতে পিটুনি খেয়ে।এক্ষেত্রে বিকৃত ব্যক্তি যৌনসঙ্গিনীর দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হলে যৌন উত্তেজনা অনুভব করেন বা যৌনমিলনে সহায়ক হয় বা মিলন ছাড়াই চরমপূলক পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে।এটা অনেকটা স্যাডিজমের মতই তবে পার্থক্যটা হলো আঘাতটা নিজ শরীরের উপর হতে হবে।
অ্যালগোলাগনিয়াঃ Algolagnia (Greek: algos মানে "pain" and lagnia মানে "lust" বা কামুকতা) ।এক্ষেত্রে শরীরের যৌন জাগানিয়া অংশে (erogenous zone) ব্যাথা তা সেটা রোগের কারণেই হোক বা আঘাতের কারণেই বা শারীরবৃত্তীয় কারণেই হোক অ্যালগোলাগনিয়াকের ক্ষেত্রে যৌন উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে।ব্যাথা থেকে কামোত্তেজনা এবং তাতে থেকে সেক্স।আমাদের দেশে এটি বিরল নয়।মেয়েদের মাসিকের শুরুর সময় তলপেট ও তৎসংলগ্ন এলাকায় যে হালকা ব্যাথা হয় তা কারো কারো মধ্যে তীব্র কামোত্তেজনা তৈরী করে।এসময় কেউ কেউ তাড়না সইতে না পেরে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
এক্সিবিশানিজমঃ-এর অর্থ হলো প্রর্দশন করা।যখন কোন পুরুষ অপরিচিত নারী বা জনসম্মুখে তার গোপনাঙ্গ আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে উন্মোচিত করে নিজে যৌন উদ্দীপনা লাভ করে তাকেই এক্সিবিশানিজম বলে।নারীর সামনে লিঙ্গ প্রদর্শন করা ও তার সাপেক্ষে মেয়েটির প্রতিক্রিয়া দেখা তার জন্য যৌন উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে।পরবর্তীতে সে এই ঘটনা কল্পনায় এনে বার বার নিজেকে যৌন উদ্দীপিত করে এবং তা থেকে হস্তমৈথুন বা অন্যন্য যৌনকর্ম করে থাকে।
ট্রান্সভেসটিজমঃ-Transvestism (‘trans’ মানে বিপরীত এবং ‘vest’ মানে পোষাক)।এ ধরণের বিকৃত যৌনাচারীরা বিপরীতলিঙ্গের পোষাক পরিধান করার মাধ্যমে তারা যৌন উদ্দীপনা লাভ করে।ট্রান্সভেস্টিক স্বামী স্বয়ং তার বউকে দেখে যতটানা কামনা বোধ করে তার চেয়ে ঢের বেশী কামোত্তেজনা অনুভব করে নিজে স্ত্রীর পোষাক পরে। অনেক সময় সে তার স্ত্রীকেও পুরুষের পোষাক পরিয়ে যৌনসুখ লাভ করে থাকে।
অটোগাইনীফিলিয়াঃAutogynephilia :Greek “auto” (self), “gynae” (woman) and “philia” (love) ।এ রোগের পুরুষরা কল্পনায় নিজের শরীরকে একটা বিবস্ত্র মেয়ের শরীর মনে করে এক হাতে তাতে স্পর্শসুখ নিতে থাকে আর আরেক হাতে হস্তমৈথুন করতে থাকে।মেয়েরাও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে নিজ শরীরকে পুরুষের শরীর মনে করে একই ধরণের উত্তেজনা অনুভব করতে পারে যেটাকে autoandrophilia বলে।
গ্র্যাফিটিঃ-Graphity(graph মানে লেখা)।বাথরুমের দেয়ালে,বই এর পাতায় বা ফেসবুকের টাইম লাইনে কিংবা পত্রিকায় যৌন উত্তেজক কথাবার্তা লিখে যৌনানন্দ লাভ করা এই ভেবে যে অন্য কেউ সেটা পড়ে যৌন উত্তেজিত হবে।তার লেখা পড়ে কেউ কামোত্তেজিত হয়েছে এটা মনে মনে কল্পনা করেই সে নিজেই কামাতুর হয়ে পড়ে।
ফোন সেক্সঃএটাকে telephone scatologia (scatos=dirt/shit বা নোংরা) ও বলা হয়।এ ধরণের বিকৃত যৌনাচারীরা ফোনের মাধ্যমে অপরিচিত বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে(তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে) যৌন বিষয়ক নোংরা কথা বলে যৌনানন্দ লাভ করে।আমাদের দেশে মোবাইলের অবাধ ব্যবহারে এ বিকৃতিটি হু হু করে বাড়ছে।
পয়জন পেন রাইটারঃ-এ ধরণের বিকৃত যৌনাচারীরা মূলতঃ অবিবাহিতা বয়স্কা কুমারী।এরা হিংসাবশতঃ বান্ধবী বা বন্ধুর স্ত্রীর কাছে তাদের স্বামীর সাথে তার যৌন সম্পর্কের কথা লিখে তাদের দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করে যৌন আনন্দ লাভ করে থাকে যদিও ঘটনাটি ডাহা মিথ্যা।
জেরেন্টোফিলিয়াঃ- Gerontophilia(Greek: geron, মানে "old man or woman") ।বৃদ্ধা বা রজঃনিবৃত মহিলা যাদের সাথে সেক্স তৃপ্তিদায়ক নয় তাদেরকে দেখলেই এদের যৌন উদ্দীপনা তৈরী হয়।যেহেতু এরা শারীরিকভাবে বাঁধাদানে অসমর্থ তাই তারা অনেকসময় এরূপ ব্যক্তির দ্বারা যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয়।বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত গাইনীকোলজিস্টের সন্তান তার সুন্দরী স্ত্রীকে হত্যা করার পর ঘটনাক্রমে জানা যায় সে ছেলের সাথে একাধিক বৃদ্ধা মহিলার যৌন সম্পর্ক ছিল।হত্যাকান্ডের পিছনে জেরেন্টোফিলিয়া দায়ী ছিল কিনা সে বিষয়ে কেউ দৃষ্টি দেয়নি।পরবর্তীতে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়।
ড্যাক্রিফিলিয়াঃDacryphilia হলো কারো কান্না বা কান্নারভাব দেখে যৌন উদ্দীপনা অনুভব করা।এ রোগে আক্রান্ত পুরুষরা ক্রন্দনরত বা অশ্রুভেজা চোখের নারীকে দেখে প্রবল কামোত্তেজনা অনুভব করে এবং সান্ত্বনা দেওয়ার নাম করে গায়ে হাত বুলানো এমনকি বুকে পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে।
নেক্রোফিলিয়াঃ-Necro মানে পঁচা বা মৃত এবং Philia মানে ভালবাসা/আসক্তি।এক্ষেত্রে বিকৃত ব্যক্তি দাফন করা হবে বা সদ্য দাফনকৃত মৃত নারীর সাথে যৌনসঙ্গম করে।এরা সাধারণতঃ রাতের বেলা কবরস্থানে এধরণের অপকর্ম করে থাকে।
মূর্তি যৌনাচারীঃAgalmatophilia (Greek agalma =statue, and philia = love) বা মূর্তি যৌনাচারীরা মূর্তি,পুতুল বা ম্যানিকুইন (পোষাকের দোকানের পুতুল) এর প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে এবং এগুলোর সাথে মৈথুন করে চরমপূলক পর্যন্ত লাভ করতে পারে।
লাস্ট মার্ডারঃ-Lust মানে কামুকতা Murder মানে খুন।এ ধরণের যৌনাচারে লিঙ্গ উথ্থান,বীর্যপাত,এমনকি চরমপূলক পর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে হত্যা একটা উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে।আপনারা নিশ্চয় সিরিয়াল কিলারের কথা শুনে থাকবেন যে একের পর এক যুবতীকে খুন করে যাচ্ছে।আসলে এটিই লাস্ট মার্ডার।মনে রাখা দরকার ধর্ষণের পর আত্মরক্ষার জন্য বা রাগের মাথায় বা হিংসাবশতঃ খুন করা লাস্ট মার্ডার নয়।লাস্ট মার্ডারের ৩টি মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে-১)এ ধরণের বিকৃত ব্যক্তিরা এ জাতীয় প্রচন্ড যৌন তাড়না নির্দিষ্ট সময় পর পর অনুভব করে ২)এরূপ তাড়নার সময় সে সুযোগমত কোন মেয়ের উপর আক্রমণ চালিয়ে ধারালো অস্ত্র দ্বারা বা কামড়িয়ে তার স্তন ও যৌনাঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে থাকে যা তার জন্য যৌন উত্তেজক হিসাবে কাজ করে ৩)পরবর্তী তাড়না অনুভব না করা পর্যন্ত সে সম্পূর্ন স্বাভাবিক মানুষের মত আচরণ করে।
চিকিৎসা কীঃপ্যারাফিলিয়ায় সৃষ্ট পূণঃ পূণঃ যৌন তাড়না(sex drive) তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করাই এর চিকিৎসার প্রাথমিক উদ্দেশ্য।একসময় শিশুযৌনাচারীদের খাসিয়া করা হতো অর্থাৎ তাদের শুক্রাশয়(testes) কেটে ফেলা হতো (castration)।কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন,আইন ও সমাজের কাছে এটা ক্রমে ক্রমে অগ্রহণযোগ্য হওয়ায় এখন আর তা করা হয় না।পরিবর্তে পুরুষ হরমোন টেস্টসটেরন বিরোধী ঔষধ ব্যবহার করা হয় যেমন medroxyprogesterone (Depo Provera নামে বেশী পরিচিত) যাকে chemical castration বলে।এর সাফল্যের হার ৬০%-৮০%।তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য এটিও যথোপযুক্ত নয়। Triptorelin (Trelstar) একটি সিনথেটিক হরমোন এবং এটা ব্রেনের হাইপোথ্যালামাসে কাজ করে পরোক্ষভাবে পুরুষ হরমোন নিঃসরণ কমায়।এটা একটা ভাল বিকল্প হিসাবে কাজ করছে।
Methylphenidate ও বিষন্নতাবিরোধী SSRI গ্রুপের ঔষধ(যেমন sertraline) ব্রেনে সেরোটনিনের মাত্রা বাড়ায় (ব্রেনে সেরোটনিন কমে যাওয়ার কারণেই Obsessive Compulsive Disorder এর মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়)।এ দুটো ঔষধ একসাথে প্রযোগ করে বেশ ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে।
এ রোগের মূল উৎপাটনে সাইকোথেরাপীর বিকল্প নাই।একক ও গ্রুপ থেরাপী বিশেষতঃ কগনিটিভ ও বিহ্যাভিয়ারাল টেকটিকগুলো ভালো কাজ করতে পারে।তবে আমাদের দেশে ধর্মীয় বিষয়টা সমাজে বেশ প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।এক্ষেত্রে রিলিজিয়াস কাউন্সেলিং বেশ কার্যকর হতে পারে।
প্যারাফিলায়ার বিষয়টা গত ২০বছর যাবৎ বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে।ফলে নানারকম গবেষণার ফলও পাওয়া যাচ্ছে।DNA এর ত্রুটি,ব্রেনের গাঠণিক ও কার্যকারীতার ত্রুটি,গর্ভাবস্থায় শিশুর উপর হরমোনের প্রভাব বিষয়গুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে এসব বিষয় বিবেচনায় আরও সহজ ও কার্যকরী চিকিৎসা উদ্ভাবন করা হবে।
কোথায় চিকিৎসা পাবেনঃজাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শ্যামলী,ঢাকা;বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউ. হাসপাতাল(পিজি হাসপাতাল)-এর মানসিক রোগ বিভাগে;সকল মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগে। এছাড়াও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আপনি এ চিকিৎসা পাবেন।
আমাদের সচেতন হওয়া কেন জরুরী?-এ রোগ নিজ থেকে ভালো হওয়া প্রায় অসম্ভব।এমনকি চিকিৎসার পরও সব রোগীকে ভাল করা সম্ভব হয় না।তাছাড়া সারাজীবনই রোগীকে ফলো আপে রাখতে হয় কারণ ভালো হয়ে যাওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে পূর্বের উপসর্গ ফিরে আসতে পারে(Relapse)।একবার ভাবুন এরকম কত শত হাজার কিংবা লাখ প্যারাফিলিয়াক আমাদের মাঝেই বাস করছে।তাদের মাথার দুষ্ট চিন্তা ও তাদের কুকর্ম আমাদের মত স্বাভাবিক মানুষকে ঘিরেই।আমরা সর্বদাই তাদের চিন্তার খোরাক ও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে আছি।পালানোর জায়গা নেই।সুতরাং আমরা সচেতন না হলে এবং সরকার প্রয়োজনীয় আইন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে আমরা প্রত্যেকেই এর শিকার হবো এবং হচ্ছি-প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পরোক্ষভাবে।
বি.দ্রঃ০১)প্যারাফিলিয়ার বর্ণনায় পুরুষদেরকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্যারাফিলিক হিসাবে দেখানো হয়েছে।কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় মেয়েদের মধ্যেও এগুলোর বেশ উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।বিষয়টা এখন আর একপেশে নয়। ০২)এ পোষ্টটি কেবলই তথ্য ও সচেতনতামূলক।রোগ নির্ণয়,চিকিৎসা ও পরামর্শের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
সূত্রসমূহঃ
01.Review of General Psychiarty by Howard H. Goldman
02.Current Medical Diagnosis & Treatment
03.Clinical Psychology by A.K.Agarwal
04.Essentials of Medicine by M.E.Ullah.
05.Forensic medicine & Toxicology by Reddy.
06.Wikipedia
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন