শুক্রবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১৮
Home »
» মঙ্গলকর প্রাকৃতিক উপাদান হলুদ
মঙ্গলকর প্রাকৃতিক উপাদান হলুদ
প্রাকৃতিক উপাদান হলুদ
মসলার জগতে হলুদের বিচরণ সর্বাধিক। প্রতিদিনের রান্নায় আমরা এর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকি অন্য সব মসলার তুলনায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলার মধ্যে অন্যতম হলুদ শুধুমাত্র মসলা হিসেবেই ব্যবহার হয়না। বিভিন্ন প্রকার প্রসাধনী, রঙ শিল্পের কাঁচামাল, কবিরাজি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এর প্রচুর ব্যবহার হয়ে থাকে। রংধনুর সাত রঙের এক রঙের নামও হলুদ, এই রঙ অনেক কবির কবিতার উপমায়ও উঠে এসেছে। যেমন হলুদ হলুদ জ্যোৎস্না, হলুদ নদী, হলুদ পাতা ঝরা সন্ধ্যা ইত্যাদি। দক্ষিন এশিয়ার সংস্কৃতি এবং অনুষ্ঠান পর্বের সঙ্গে এটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমাদের দেশে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয় বর-কনের গায়ে হলুদ ছোঁয়ানোর মধ্য দিয়ে, এ ছাড়া যেন বিয়েই সম্পন্ন হয়না। হলুদের অনুষ্ঠান পর্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক কবি সাহিত্যিক রচনা করেছেন বিখ্যাত সব গান এবং কাব্য। এর মধ্যে বহুল জনপ্রিয় একটি গান "হলুদ বাটো মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মৌ"। এছাড়াও বহু রকমের হলুদের গান 'হলুদ উৎসবে' গাওয়া হয়ে থাকে।
আদা পরিবারের Zingiberaceae এক প্রকার গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের শিকড় বা মূল হলো হলুদ। এর বৈজ্ঞানিক নামঃ Curcuma longa. এরা বহুবর্ষজীবী গাছ। হলুদের আদিবাস দক্ষিনপূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশ। দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্য প্রাচ্যের রান্নায় হলুদ মসলা হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় সেই প্রাচীন কাল থেকে। ভারতবর্ষে প্রায় ২৫০০ বছর ধরে হলুদের ব্যবহার হয়ে আসছে। যা এখন বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি এবং ঐতিহ্যবাহী চীনা ঔষধের একটি বিশেষ উপাদান। প্রাচীন কালে প্রথম দিকে শুধু কাপড়ে রঙিন ছাপানোর কজে হলুদ ব্যবহার করা হতো। এরপর আস্তে আস্তে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ঔষধি গুণের বৈশিষ্ট্যগুলির প্রকাশ পেতে থাকে। তখন থেকে রান্নার রঙ ও স্বাদ বাড়াতে এবং বিভিন্ন ধরণের রোগের ঔষধ হিসেবে হলুদের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।
এশিয়ান খাবারের প্রধান উপাদান গুলির মধ্যে হলুদ অন্যতম মসলা। এই জন্যই বোধকরি একে অনেকে মসলার রাণী উপাধি দিয়ে থাকেন।
হলুদ গাছ বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে। এই গাছ দেখতে অনেকটা কলাগাছের মত, দেখলে মনে হয় ছোট জাতের কলাগাছ। কান্ডের রঙ হালকা সবুজ এবং ৬/৭ ইঞ্চি লম্বা হতে পারে। হলুদের পাতা লম্বাটে, পাতার রঙ হাল্কা সবুজ। এর কান্ডের মাঝখান থেকে ফুল বের হয়, একটা গাছে এক গুচ্ছ ফুলই ফোটে। ফুল থেকে ফল বা বীজ হয়না। হলুদ অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে থাকে, এর প্রধান ব্যবহার যোগ্য অংশ হলো এর মূল। মূলের গায়ে শাখা মূল থাকে, দেখতে অনেকটা আদার মতো। হলুদের উপরের গায়ের রঙ বাদামী ধূসর, ভেতরের রঙ কমলা মিশ্রিত হলুদ। কাঁচা অবস্থায় এটি নরম এবং রসালো থাকে। এর ফুল বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে, তার মধ্য শাদা ফুলের হলুদ গাছ বেশী দেখা যায়। এছাড়া আরো আছে হালকা গোলাপি, লাল ও শাদার সঙ্গে গোলাপি লাল এবং অন্য রঙের মিশ্রণ। আমদের দেশে হলুদের বেশ কযেক প্রকার উন্নত মানের জাত রয়েছে। ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভালো জন্মে এরা। এই গাছের জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাতের দরকার হয়। হলুদ তোলার সময় যদি এর কন্দ মাটির তলায় থেকে যায়, তবে সেখান থেকে আবার গাছ জন্মায়। এইভাবে অনেক সময় বুনো হলুদের গাছ বন-জঙ্গলে বছরের পর বছর বেঁচে থাকে। বুনো হলুদও খাওয়া যায়। এই গাছ সহজেই প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।
বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায় হলুদ জন্মে। এর মধ্যে রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, নীলফামারী, ময়মনসিংহ ও পার্বত্য জেলা গুলোতে এর ব্যাপক চাষাবাদ হয়। আমাদের দেশে ফসলের জমিতে বা বসত বাড়ির আশে-পাশে হলুদের চাষ করা হয়ে থাকে। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই হলুদের চাষ করা করা যায়। কিন্তু এর চাষের জন্য উর্বর দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি বেশী উপযোগী। পানি জমে না এমন জমিতে এটি ভালো জন্মে, এই কারণে পাহাড়ী অঞ্চলে এর ব্যাপক ফলন হয়। হলুদ চাষের জন্য সমপরিমাণ আলোছায়া যুক্ত স্থান ভালো। ছায়াযুক্ত স্থানেও হলুদ জন্মে, তবে ফলন কম হয়। উঁচু জমি এর চাষের জন্য ভালো। হলুদ চাষে ঝুকি কম, সেইজন্য একবার শুধু লাগাতে পারলে বেশী যত্নের প্রয়োজন হয়না। আমাদের দেশে ডিমলা ও সিন্দুরী নামে দুইটি উচ্চ ফলনশীল জাত রয়েছে। চৈত্র মাসের শেষ হতে বৈশাখ মাস পর্যন্ত হলুদ রোপণ করার সময়। জমি খুব ভা্লো করে ২-৩ বার চাষ দিযে মাটি ঝুরঝুরে করে হলুদ চাষের উপযোগী করতে হয়। উন্নতমানের বীজকন্দ বেছে নিতে হয় লাগানোর জন্য। সাধারণত হলুদ লাগানোর ৯-১০ মাস পর পাতা শুকিয়ে গেলে এটি সংগ্রহ করা হয়। বছরে সাধারণত একবার এর গাছ তোলা হয়।
হলুদ তোলার পর পাতা, শিকড়, কান্ড, সব কেটে পরিষ্কার করে এর কন্দ গুলো ৩/৪ বার পানি দিয়ে ধুয়ে আলাদা করতে হয়। এরপর যেখানে রোদ না লাগে এমন জায়গায় রেখে পাতা দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এই ভাবে ২/৩ দিন হলুদের ঘেমে যাওয়া পানি ঝরানো হয়। এই পদ্ধতিকে হলুদের ঘাম ঝরানো বলা হয়ে থাকে। উঠানোর ৩/৪ দিনের মধ্য সিদ্ধ করতে হয়, তা না হলে এর কন্দ পচে যেতে পারে। হলুদের কন্দের আকারের উপর নির্ভর করে কতক্ষণ সিদ্ধ করতে হবে। এই জন্য ভিন্ন ভিন্ন আকারের কন্দ বেছে আলাদা করে নিতে হয়, এবং কতক্ষনের মধ্যে সেই গুলো সিদ্ধ হবে সেই সময় অনুযায়ী সিদ্ধ করা হয়। সাধারনত ১ থেকে ৩/৪ ঘন্টাও লাগতে পারে সিদ্ধ করতে। মাটি বা লোহার পাত্র হলুদ সিদ্ধ করার জন্য বেশি উপযোগী। সিদ্ধ করার পরপরই ভালো ভাবে রোদে শুকাতে হয় প্রায় দুই সপ্তাহ। এরপর হলুদ মসলা হিসেবে খাওয়ার উপযুক্ত হয়। পরের বছর লাগানোর জন্য এর সতেজ কন্দ বিভিন্ন উপায়ে সংরক্ষন করা হয়ে থাকে।
ভেষজ ও পুষ্টিগুণে গুণান্বিত হলুদ। এর গুনাগুণ নিয়ে যুগ যুগ ধরে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়ে আসছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া একটি বিশেষ তথ্য হলুদে ‘কারকিউমিন’ নামক একটি বায়ো-এক্টিভ যৌগের উপস্থিতি। আর এই ‘কারকিউমিনের মধ্যে রয়েছে বিশেষ উপাদান অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিবায়োটিক যা বিভিন্ন অসুখের সংক্রমণকে দমন করার ক্ষমতা রাখে। 'কারকিউমিন' হলুদে বেশী আর আদায় স্বল্প পরিমাণে থাকে। প্রত্যেক মানুষের ত্বক আলাদা ধরনের। ত্বকের অধিকাংশ সমস্যা সমাধান করতে হলুদে থাকা কারকিউমিনের অবদানের তুলনা হয়না। যে কোনো ত্বকের সমস্যায় কাঁচা হলুদ বাটা বা শুকনো গুড়ো হলুদ বিভিন্ন দ্রব্য যেমন চন্দন, চালের গুড়ো, ডালের গুড়ো, দুধের সর ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ত্বকে কখনো সরাসরি হলুদ লাগানো উচিত না। কারণ, অনেকের হয়ত এতে অ্যালার্জি থাকতে পারে। সেইজন্য হাতে বা পায়ে সামান্য একটু লাগিয়ে পরীক্ষা করে নিলে ভালো হয়। হলুদে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এতে প্রচুর ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্যারোটিন, আমিষ, এবং চর্বি রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী নানা সংক্রামক রোগ দমন করতে হলুদ সবচেয়ে কার্যকর ও মঙ্গলকর প্রাকৃতিক উপাদান।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন